রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বৈধ লাইন্সেস ছাড়া চিকিৎসা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসার জন্য সরকার নির্ধারিত হাসপাতাল ও ল্যাবও রয়েছে।
প্রতি অর্থবছরেই এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন করা বাধ্যতামূলক; কিন্তু ২০১৮ সালে নবায়ন ফি বাড়ানোর পর থেকে এ কার্যক্রম অনেকটাই মন্থর হয়ে পড়ে। এ জন্য হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মনিটরিং না থাকা ও গাফিলতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া বিষয়টি দেখভালের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পর্যাপ্ত জনবলও নেই। নিয়মিত মনিটরিং করার মতো তেমন উদ্যোগ তাদের কখনো ছিল না।
করোনা ভাইরাস মহামারীর মধ্যে কোভিড চিকিৎসার নামে রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আসার পর জানা যায়, বৈধ লাইসেন্স ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া কীভাবে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে কোভিড চিকিৎসার জন্য চুক্তি হলো তা জানতে চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছে। এ সংবাদ
গণমাধ্যমে প্রকাশের পর দেশের হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বৈধ লাইসেন্সের বিষয়টি আলোচনায় আসে।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্তের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকে। র্যাবের অভিযানে রিজেন্ট হাসপাতালের কেলেঙ্কারির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর এ জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের দায়ী করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের পর থেকে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন নবায়ন অনেকটা বন্ধ হয়ে পড়ে। ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন ফি ও নিবন্ধন নবায়ন ফি পাঁচ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার ও সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নবায়ন ফি ধরা হয় আড়াই লাখ টাকা। অন্যদিকে বিভাগীয় ও সিটি করপোরেশন এলাকার বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নবায়ন ফি ১০-৫০ শয্যার জন্য ৫০ হাজার টাকা, ৫১-১০০ শয্যার জন্য এক লাখ, ১০০-১৪৯ শয্যার ক্ষেত্রে দেড় লাখ, ২৫০ শয্যার জন্য দুই লাখ টাকা করা হয়।
একই শয্যাসংখ্যার জেলা পর্যায়ের হাসপাতালের জন্য যথাক্রমেÑ ৪০ হাজার টাকা, ৭৫ হাজার, এক লাখ ও দেড় লাখ এবং উপজেলা পর্যায়ের জন্য যথাক্রমেÑ ২৫ হাজার, ৫০ হাজার, ৭৫ হাজার ও এক লাখ টাকা করা হয়। এ ছাড়া আবাসিক এলাকায় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক না রাখার নির্দেশনা থাকার বিষয়টি নবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা আমাদের সময়কে বলেন, ২০১৮ সালে অনলাইনে লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর নবায়ন ফিও বাড়ানো হয়। এর পর থেকেই মূলত লাইসেন্স নবায়ন কমতে থাকে। ওই সময় হাসপাতালগুলো নবায়ন ফি বাড়ানোর বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে সময় বৃদ্ধির জন্য বারবার চিঠি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সময় বাড়ানো হলেও বেঁধে দেওয়া হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক আমিনুল হাসান পলাশ জানান, বর্তমানে ১৫ হাজারেরও বেশি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মধ্যে ৫ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে। অন্যগুলোর নবায়ন না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, লাইসেন্সের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র, জনবল, সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র, কর সনদপত্রসহ অন্যান্য কাগজপত্র দিতে হয়। এসব কাগজপত্র দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের লাইসেন্স নবায়ন হয়নি। তিনি জানান, এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত নোটিশ দেওয়ার পাশাপাশি সংবাদপত্রেও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে; কিন্তু পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে তারা এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারছেন না।
এ প্রসঙ্গে আমিনুল হাসান বলেন, রাজধানীতে ৫ হাজারের বেশি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এগুলো দেখার জন্য তাদের লোকবল মাত্র তিনজন।
র্যাবের অভিযানে রিজেন্ট হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা ছাড়া করোনা ভাইরাস পরীক্ষার মনগড়া ফল দেওয়ার প্রমাণ পাওয়ায় সিলগালা করা হয়েছে হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখা। রিজেন্টের নানা অপকর্ম বের হয়ে আসার পর গত বুধবার অধিদপ্তরের সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর লাইসেন্স নবায়ন করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আগে লাইসেন্স নবায়নে দুই সপ্তাহ সময় লাগলেও এখন দুদিনে লাইসেন্স নবায়ন করা হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া আমাদের সময়কে বলেন, রিজেন্টের ঘটনার পর হাসপাতালগুলোকে লাইসেন্স নবায়ন করতে বলা হয়েছে। এখন দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের; কাজটি তাদেরই করতে হবে।
জানা গেছে, কোভিড-১৯ রোগী বেড়ে যাওয়ায় ২৯টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবকে করোনা ভাইরাস পরীক্ষা ও সেবা দেওয়ার অনুমতি দেয় সরকার। অনুমতিপ্রাপ্ত এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও কয়েকটির লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি।
আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর ধানমন্ডিতে তিনটি, মগবাজার ও গুলশান এলাকার একটিসহ সরকারের অনুমতি নিয়ে কোভিড চিকিৎসা দিচ্ছে এমন কয়েকটি হাসপাতালের লাইসেন্স নেই। এর মধ্যে একটি হাসপাতালের পিসিআর মেশিন নেই। কোভিড চিকিৎসার জন্য সরকার নির্ধারিত আরও কয়েকটি হাসপাতাল রয়েছে, যেগুলোতে করোনা রোগীর সেবা প্রদানে পর্যাপ্ত অক্সিজেন, আইসিইউসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেই। এর পরও এসব হাসপাতাল, ক্লিনিককে মারাত্মক ছোঁয়াচে প্রাণঘাতী এ রোগের চিকিৎসা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং করোনা রোধে সরকার গঠিত কারিগরি পরামর্শ কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বিস্ময় প্রকাশ করে আমাদের সময়কে বলেন, লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া হাসপাতাল চলে কীভাবে? তিনি মনে করেন, এ অবস্থার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরÑ উভয় পক্ষই দায়ী। কারণ হাসপাতালগুলোর লাইসেন্স নবায়নে অনীহা রয়েছে আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রয়েছে চরম গাফিলতি। তিনি বলেন, লাইসেন্স নবায়ন এমন একটি প্রক্রিয়া, যা হাসপাতালগুলো করতে বাধ্য এবং না করলে তাদের শাস্তির আওতায় আনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজ; কিন্তু কেউই তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছেন না।
Leave a Reply